IQNA

লালমনিরহাটে সাহাবি যুগের মসজিদ

20:29 - May 08, 2022
সংবাদ: 3471824
তেহরান (ইকনা): ঐতিহাসিক ‘হারানো মসজিদ’। রংপুর-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের এক কিলোমিটার দক্ষিণে লালমনিরহাট সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস মৌজায় অবস্থিত। ১৯৮৬ সালের দিকে আশ্চর্যজনকভাবে লালমনিরহাটে পাওয়া যায় এই প্রাচীন মসজিদ, যা বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমনের প্রারম্ভিক ইতিহাসের রাজসাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৩ শ বছর আগে ৬৯ হিজরিতে।
প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতার দজলা ও ফোরাতের মতো ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম অববাহিকাগুলোর একটি গণ্য করা হয়।
রোমান ও জার্মান ইতিহাসবিদদের লেখায় আরব ও রোমান বণিকদের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাকে বাণিজ্যিক পথ হিসেবে ব্যবহারের কথা লিপিবদ্ধ আছে এবং বেশ কয়েকটি চলমান গবেষণায় ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রমাণও পাওয়া গেছে।
 
ধারণা করা হয়, হজরত আবু ওয়াক্কাছ (রা.) এই অঞ্চল দিয়েই চীনে পাড়ি জমিয়েছিলেন। বর্তমানে চীনের বিস্মৃত কোয়াংটা নদীর ধারে কোয়াংটা শহরে তাঁর নির্মিত মসজিদ ও তাঁর সমাধি রয়েছে।
 
ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক টিম স্টিল দাবি করেন, খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পার ধরে সিকিম হয়ে চীনের মধ্য দিয়ে আরব ও রোমান বণিকদের বাণিজ্য বহরের যাতায়াতের অনেক প্রমাণ রয়েছে তাঁর কাছে। ধারণা করা হয়, এই হারানো মসজিদটি সাহাবি আবু ওয়াক্কাছ (রা.) নির্মাণ করেছেন।
 
লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রামের একটি আড়ার মাঝে আবিষ্কৃত হয় এই হারানো মসজিদটি। একসময় স্থানীয় লোকজন হিংস্র জীবজন্তু, সাপ-বিচ্ছু ইত্যাদির ভয়ে এই আড়াটির ভেতরে প্রবেশ করত না। ১৯৮৩-৮৪ সালে স্থানীয়রা আড়াটি চাষাবাদের জন্য পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেয়। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে গিয়ে তারা দেখে জায়গাটি সমতল জমি থেকে উঁচু এবং সেখানে রয়েছে প্রায় সাত-আটটির মতো মাটির উঁচু টিলা।
 
জায়গাটি সমতল করার জন্য খনন শুরু হলে সেখানে প্রাচীন কালের তৈরি প্রচুর ইট পাওয়া যেতে থাকে। যে ইটগুলোতে অঙ্কিত কিছু নান্দনিক ফুল। সবাই ভেবে নিয়েছিল পুরনো কোনো জমিদার কিংবা রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ হতে পারে এটি। কিন্তু ১৯৮৬ সালের ১০ মহররমের একটি ঘটনা তাদের টনক নাড়িয়ে দেয়। সেদিন গ্রামের আইয়ুব আলী নামের এক ব্যক্তি অন্য অনেকের মতো ইটের স্তূপ থেকে ইট কুড়িয়ে বাড়িতে নিয়ে দেখেন ইটের ওপর কিছু একটা লেখা। লেখা স্পষ্ট দেখার জন্য টিউবওয়েলের পানিতে ভালোমতো ধুয়ে তিনি দেখতে পান এটি কোনো প্রাচীন শিলালিপি। যাতে লেখা আছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, হিজরি সন ৬৯। ’
 
এরপর স্থানীয় লোকজন বুঝতে পারে, এটি কোনো হারানো মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। তারা অত্যন্ত সতর্কতার সহিত মসজিদটির উদ্ধারকাজ চালায়। আবিষ্কার করে মসজিদের মেহরাব, মসজিদসংলগ্ন ঈদগাহ, খুতবা দেওয়ার মিম্বার ইত্যাদি। ২১ ফুট চওড়া ও লম্বা এই মসজিদের চারটি খুঁটি ছিল, যার দুটিই ধ্বংস হয়ে গেছে। এর পর থেকে সেখানকার লোকজন মসজিদের আঙিনায় টিন দিয়ে সাদামাটা একটি মসজিদ নির্মাণ করে নামাজ আদায় করে আসছেন। স্থানীয়রা মসজিদটির নাম দিয়েছেন ‘হারানো মসজিদ’। বর্তমানে মসজিদটি নতুন করে সংস্কার করা হলেও প্রাচীন মসজিদের ইটগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে মসজিদের ভেতরেই।
 
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষরা এখানে বসতি শুরু করেছিলেন। একসময় এই পতিত জায়গাটির মালিক ছিলেন ‘পচা দালাল’ নামের এক ব্যক্তি। আনুমানিক ১৯৪৯ সালে ইয়াকুব আলী নামের এক ব্যক্তি তাঁর কাছ থেকে জায়গাটি কিনে নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে উত্তরাধিকারসূত্রে জায়গাটির মালিক হন নবাব আলী এবং তাঁর মালিকানাধীন অবস্থায়ই মসজিদটি আবিষ্কৃত হয়েছে। পরে তিনি জায়গাটি হারানো মসজিদ কমপ্লেক্সের নামে দিয়ে দেন।
 
প্রতিদিন দেশের দূর-দূরান্ত থেকে বহু পর্যটক এই মসজিদটি দেখতে আসেন। অনেকেই এখানে এলে অন্তত এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
captcha