IQNA

বাংলাদেশের সাথে কৌশলগত বন্ধন বাড়ানো সংক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য

14:46 - January 29, 2022
সংবাদ: 3471352
তেহরান (ইকনা): চীনকে সমুদ্র পথে সার্বিক ভাবে ঘেরাও ও জব্দ ( ইন্দো - প্যাসিফিক নীতি শক্তিশালী ) করতে এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া , ভারতের পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ পশ্চিম চীনে নজরদারি ও অপতৎপরতা চালানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে কৌশলগত বন্ধন বাড়াতে  এবং ধীরে ধীরে বাংলাদেশকে চীন  বিরোধী জোট  কোয়াড নামক খোয়ারে ঢুকাতে চাচ্ছে ।

যদিও বাহ্যত: " যুক্তরাষ্ট্র বলছে : বাংলাদেশকে চীন বিরোধী শিবিরে বের করে আনা হবে না। তবে চীনের ক্রমবর্ধমান উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি ভারসাম্য বজায় রাখতে বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত বন্ধন বাড়াতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।"

এখানে লক্ষণীয় হচ্ছে বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বন্ধন বাড়ানো । আর পশ্চিমারা বিশেষ করে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুবই চতুর ও কৌশলী । এদের কৌশলের প্যাচের মধ্যে পড়লে নিস্তার নেই । যথেষ্ট সাবধান ও সতর্ক হতে না পারলে বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশলগত বন্ধনই বাংলাদেশকে অবশেষে চীন বিরোধী শিবির অর্থাৎ কোয়াডের খোয়ারে ঢুকিয়ে দিতে পারে । আর

এই খোয়ারে ঢুকলে বাংলাদেশের লাভের চাইতে ক্ষতিই হবে বেশি । বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এ থেকে চুটিয়ে ফায়দা উঠাবে । কারণ , তখন বাংলাদেশ চীনের রোষানলে পড়ে যাবে এবং এ দেশ  পরিণত হবে চীন - ভারত - মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কুরুক্ষেত্রে । ভবিষ্যতে চীনকে কেন্দ্র করে কোনো আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ ও যুদ্ধ লাগলে চীনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ভূখণ্ড তখন সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা কোয়াড জোট কর্তৃক এবং চীনও নিজের প্রতিরক্ষার জন্য শত্রুর বিরুদ্ধে তখন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যুদ্ধ করবে ও হামলা চালাবে । আর এ বাংলাদেশ তখন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে বিদেশী শক্তিসমূহের জন্য ! ট্রাম্প তো আগেই বে অব্ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভের ঘোষণা দিয়েছিল। আর ট্রাম্পের ঘোষিত এই বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভের প্রকৃত স্বরূপটাও ভালোভাবে বুঝতে হবে । বঙ্গোপসাগর , চট্টগ্রামের গভীর সমুদ্র বন্দর , মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চল ও এ অঞ্চলস্থ আকিয়াব বন্দর , পার্বত্য চট্টগ্রাম , ভারতের সাতকন্যা , বিখ্যাত সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লোলুপ দৃষ্টি তো রয়েছে বহু দিন ধরেই । ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও নেপথ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত রক্তক্ষয়ী সামরিক ক্যুদেতায় শেখ মুজিব সরকারের পতন হয়েছিল আসলে বঙ্গোপসাগর ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের মার্কিন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার কারণেই । ঐ ক্যুদেতার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে

১৯৭৫ সালে সোভিয়েত শিবির ও বলয় থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছিল । তখন বিশেষ করে সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তী দশক গুলোয় ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পর্যন্ত হয়তো সম্ভাব্য সোভিয়েত প্রতিক্রিয়ার ভয়ে এই অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিরত থাকতে পারে । আবার ১৯৭৯ সালে পশ্চিমা পন্থী শাহ শাসিত ইরানে ইসলামী বিপ্লব এবং ঐ বছরের শেষের দিকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের কারণে আফগানিস্তানে মুজাহিদ গণ কর্তৃক পাকিস্তান কেন্দ্রিক সোভিয়েত বিরোধী তৎপরতা জোরদার হওয়ার জন্য এবং যেহেতু চীন তখনও অর্থনৈতিক দৈত্য ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ড্রাগোনে পরিণত হয় নি সেহেতু বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর ও চট্টগ্রামের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে নি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । কিন্তু এ অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের ভবিষ্যত পরিকল্পনা ঠিকই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত করে রেখেছে বহু বছর পূর্বে । আর চীন ১৯৯১ সালের পর থেকে পরবর্তী দশকগুলোতে পাশ্চাত্য বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাশ কাটিয়ে বিশ্বের প্রথম

অর্থনীতি হতে যাচ্ছে বলে এখন থেকে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করাই বিশেষ লক্ষ্য ও ব্রতে পরিণত করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সে লক্ষ্যেই অস্ট্রেলিয়া , দক্ষিণ কোরিয়া , জাপান , তাইওয়ান , ভারত ও পারস্য উপসাগরীয় আরব রাজতান্ত্রিক দেশসমূহ বিশেষ করে আরব আমিরাতকে নিয়ে ইন্দো প্যাসিফিক কোয়াড জোট গঠন করে সাগর পথে চীনকে সম্পূর্ণ ঘেরাও - এর ষোল কলা পূর্ণ করার জন্য কোয়াড জোটের খোয়ারে বাংলাদেশ ও উত্তর পূর্ব বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলকে ঢুকানোর পায়তারা শুরু করেছে । আর এ ব্যাপারে চীনও কিছু দিন আগে বাংলাদেশকে সাবধান ও হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল । এই কোয়াডের সাথে অবশ্যই ব্রেক্সিট ও নব্য ফাঁস হওয়া অ্যাংলোফোনিক (অর্থাৎ ইংরেজী ভাষাভাষী )দেশ ত্রয়ের ( মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া ) অকূস চুক্তির নিবিড় সম্পর্ক আছে । ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ফ্রান্সের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ট মিত্ররাও এই অকুস চুক্তি সম্পর্কে অন্ধকারেই ছিল বা তাদেরকে অন্ধকারেই রেখে দিয়েছিল এই অ্যাংলোফোনিক দেশত্রয় ( মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ব্রিটেন , অস্ট্রেলিয়া ) । অবশ্য এখন এই তিন দেশ । তবে অপর দুটি অ্যাংলোফোনীয় দেশ ( কানাডা ও নিউজিল্যান্ড যারা হচ্ছে আসলে অস্ট্রেলিয়ার মতো ব্রিটেনেরই স্যাটেলাইট স্টেট বা উপগ্রহ সদৃশ্য রাজ্য ) গোপনে ঠিকই এই চুক্তির সাথেই আছে । আর ব্রেক্সিট করে ব্রিটেন অপর অ্যাংলোফোনীয় দেশগুলোর সাথে বিশেষ সামরিক , রাজনৈতিক , সাংস্কৃতিক , অর্থনৈতিক স্ট্র্যাটেজিক জোট গঠন করে ব্রিটিশ কমন ওয়েল্থ জোট , জাপান , দক্ষিণ কোরিয়া , তাইওয়ান , সিঙ্গাপুর , ব্রুনাই , পারস্য উপসাগরীয় রাজতান্ত্রিক আরব দেশগুলোকে এই অ্যাংলোফোনীয় জোটের সাথে নিয়ে এক মহা বিশ্ব জোট গঠন করে প্রাক্তন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মতো এক নয়া অ্যাংলোফোনীয় জোট সাম্রাজ্য গঠন করে বিশ্বের সমুদয় জ্বালানি তেল ও গ্যাস সম্পদ , অন্যান্য খনিজ সম্পদ ও কাঁচা মালের উৎস্য এবং সকল গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক বাণিজ্যিক রুট দখলে আনার সর্বনাশা প্ল্যান এঁটেছে । আর এটা বাস্তবায়ন করতে পারলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন , চীন , রাশিয়া , ইরান , উত্তর কোরিয়া , ভেনেজুয়েলা , কিউবার মতো আর যত প্রতিদ্বন্দ্বী ও বৈরী শক্তি ও দেশ আছে তাদেরকে যেমন কোণঠাসা ও জব্দ করা যাবে ঠিক তেমনি তাদের সাথে চুটিয়ে ব্যবসা বাণিজ্যও করা যাবে এবং লাভের পাল্লা বা ভাগটা সবসময় তখন এই নয়া অ্যাংলোফোনীয় জোট সাম্রাজ্যের পকেটেই থাকবে !! আর এ ভাবে ব্রিটেন , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের স্যাটেলাইট রাজ্য ত্রয় ( কানাডা , অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ) বিশ্বের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে ব্রেক্সিট

হওয়ার পর থেকে । আর অকূস চুক্তি সে লক্ষ্যেই এবং এর মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়া পারমাণবিক শক্তিধর দেশে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । কারণ , ফ্রান্সের সাথে অস্ট্রেলিয়া কয়েক দশ বিলিয়ন ডলারের সম্পাদিত সাবমেরিন ক্রয় চুক্তি বাতিল করে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পারমাণবিক সাবমেরিন তৈরির চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যা তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন , অন্যতম প্রধান মিত্র দেশ ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও ক্ষুব্ধ করেছে ।

এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় ভবিষ্যতে মানব জাতি নয়া অ্যাংলোফোনীয় জোট সাম্রাজ্যের উত্থানে বিশ্ব ব্যাপী আরো বহু রক্তক্ষয় , যুদ্ধ , দ্বন্দ্ব - সংঘাত , সংঘর্ষ , অশান্তি , গোলযোগ ও কুরুক্ষেত্র প্রত্যক্ষ করবে । আর বাংলাদেশ ও বঙ্গপোসাগরীয় অঞ্চল নয়া অ্যাংলোফোনীয় জোট সাম্রাজ্যের উত্থানের পাজেলের সংযোজন ও পূর্ণতা বিধান কারী চেইনের রিং হতে যাচ্ছে কি ? আর তা হলে এ অঞ্চল হবে চীনের সাথে ভারত - মার্কিন নেতৃত্বাধীন অ্যাংলোফোনীয় জোট সাম্রাজ্যের টানাপোড়েনের কুরুক্ষেত্র এবং এই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা ভীষণ ভাবে ব্যাহত হবে যা হাজার হাজার নয় মিলিয়ন মিলিয়ন বেগুনাহ ( নিরাপরাধ ) মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে । রোহিঙ্গা সমস্যা ভবিষ্যত সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির সামান্য পূর্বাভাস মাত্র । তাই এ সমস্যার ন্যায্য সমাধান না হলে গোটা অঞ্চলের ভবিষ্যত শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে । কারণ এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান না হলে সকল আঞ্চলিক সমস্যাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে । সাত কন্যা , পার্বত্য চট্টগ্রাম , রাখাইন সহ অত্র অঞ্চলকে বিশ্বের পরাশক্তি সমূহ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাই চাপা পড়া পুরোনো সমস্যা ও বিরোধকে উস্কে ও চাঙ্গা করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবেই । আর সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষক মহল ও বিশেষজ্ঞদের মতে ভেঙ্গে যাওয়ার আগে ইয়োগোস্লাভিয়ার  মতোই হয়ে যাচ্ছে । তাই মিয়ানমারকে এ অঞ্চলের আঞ্চলিক বিরোধ ও অস্থিরতার ব্রিডিং গ্রাউন্ড ও সূতীকাগার করে ফেলতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার আঞ্চলিক বশংবদ তাবেদার মিত্ররা । এই গোলযোগের সুযোগ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে বসে পূর্ব ভারত , দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং ভারত সীমান্ত সংলগ্ন চীনা অঞ্চলের ( দক্ষিণ পশ্চিম চীন ) উপর আধিপত্য কামী নজরদারি করতে পারবে । আর এটা করলে অথবা কোয়াড জোটে বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হলে বাংলাদেশ সহ এ গোটা অঞ্চল চীন ও কোয়াড জোটের বসচা কেন্দ্র হবে ! এ  অলক্ষণে মুহূর্ত ও অধ্যায় যাতে এ অঞ্চলের জনগণকে দেখতে না হয় সে জন্য আমাদের সবার ভেবে চিন্তে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে । আর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সার্বিক ভাবে বাংলাদেশের যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া যাতে করে যেন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরা  শক্তিগুলো যেন এ দেশ ও এ অঞ্চলের উপর লোভাতুর দৃষ্টি নিয়ে নিজেদের  অমানবিক অনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা চাপিয়ে দিতে ও বাস্তবায়ন করতে এবং আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলা খেলতে না পারে ।

 

মুহাম্মদ আব্দুর রহমান

captcha