IQNA

শাহাদাতের সর্বোচ্চ মহিমায় ভাস্বর মহররম (পর্ব-৩)

14:22 - September 25, 2017
সংবাদ: 2603912
গত দুই পর্বে আমরা কারবালার ঘটনার প্রেক্ষাপট তুলে ধরার চেষ্টা করেছি যাতে এটা স্পষ্ট করা যায় যে কীভাবে নবীর (সা.) উম্মতই নবীর (সা.) সন্তানকে হত্যা করলো (!)। কারণ, ইমাম হোসাইনের (আ.) মর্মান্তিক শাহাদাত এক বিষাদময় ঘটনা কিংবা আল্লাহর পথে চরম আত্মত্যাগের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্তই শুধু নয়, এ ঘটনায় মুসলমানদের বেশিরভাগেরই ভূমিকা ছিল বড়ই অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য।

বার্তা সংস্থা ইকনা: রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তিরোধানের মাত্র ৫০ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই এ হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। তাও আবার রাসূলের (সা.) সেইসব শত্রুর পতাকাতলে দাঁড়িয়ে মুসলমানরা রাসূলের (সা.) সন্তানের উপর এ হত্যাকাণ্ড চালায় যাদের সাথে রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের আগ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে যুদ্ধ করে গেছেন!

আসলে মক্কা বিজয়ের পর যখন চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার তখন ইসলামের ঐ চির শত্রুরাও বাধ্য হয়েই নিজেদের গায়ে ইসলামের একটা লেবেল লাগিয়ে নেয়। তাই বলে ইসলামের সাথে তাদের শত্রুতার কোনো কমতি ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের একটি উক্তি সুপ্রযোজ্য। তিনি বলেছিলেন-

"তারা মুসলমান হয়নি, ইসলাম গ্রহণের ভান করেছিল মাত্র।”

আবু সুফিয়ান প্রায় ২০ বছর ধরে রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে যুদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়, শেষের দিকে ৫/৬ বছর সে ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং ফেতনা সৃষ্টিতে সরদারের ভূমিকা পালন করে। মোয়াবিয়া তার পিতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতায় নামে। এভাবে আবু সুফিয়ানের দল অর্থাৎ উমাইয়ারা ইসলামের চরম শত্রুতে পরিণত হয়। অথচ আমরা অত্যন্ত আশ্চর্যের সাথে প্রত্যক্ষ করি যে, রাসূলুল্লাহর (সা.) ওফাতের মাত্র দশ বছর পরে সেই মোয়াবিয়া এসে ইসলামী শাসনযন্ত্রের শীর্ষে আরোহণ করে শাম বা সিরিয়ার গভর্নর হয়ে বসে। আরও বিশ বছর পরে ইসলামের এই শত্রু  হয়ে বসলো স্বয়ং মুসলমানদের খলীফা!

এখানেই শেষ নয়, রাসূলের (সা.) মৃত্যুর পর পঞ্চাশ বছর পর এবার মুসলমানদের খলীফা হল মোয়াবিয়া-পুত্র ইয়াজিদ। আর এই ইয়াজিদ নামায, রোযা, হজ্ব যাকাত তথা ইসলামের বিধি-বিধান পালনকারী মুসলমানদেরকে সাথে নিয়ে অর্ধ-শতাব্দী গড়াতে না গড়াতেই রাসূলের (সা.) সন্তানকে হত্যা করল। এখন প্রশ্ন হল যে, প্রথমতঃ কিভাবে মুসলিম শাসন ক্ষমতা ইসলামের ঘোর শত্রু আবু সুফিয়ানের দলের হাতে পড়ল?

এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় যে, উমাইয়াদের মধ্যে প্রথমভাগে মুসলমান হবার গৌরব অর্জন করেছিল এবং ইসলামের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করত না, বরং ইসলামের জন্যে অনেক অবদানই রেখেছিল এমন ব্যক্তির খলীফার পদ লাভই ছিল এর মূল কারণ। এর ফলেই উমাইয়ারা সর্ব প্রথম মুসলিম খেলাফত লাভ করার সুযোগ পায়। আর এ সুযোগের  অপব্যবহার করে তারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থাকে নিজেদের মুলুকে বা ব্যক্তিগত রাজত্বে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল। উমাইয়ারা তৃতীয় খলিফা ওসমানের শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি ছড়ায় ও গোলযোগ সৃষ্টি করে। এতে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং শেষ পর্যন্ত মোয়াবিয়া তার সে লালসা পূরণের জন্য মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেল।

মোয়াবিয়া ওসমানের রক্তভেজা জামা সবার সামনে মেলে ধরে তার অসহায়ত্বকে গতিশীল রূপ দেয় এবং বলে বেড়ায়, ‘যেহেতু ওসমানের হত্যার পর আলী (আ.) খলীফা হয়েছেন, তাছাড়া ওসমানের হত্যাকারীদেরকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন-তাই ওসমান হত্যার জন্য মূলতঃ আলীই (আ.) দায়ী।’ এই বলে সে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকে যাতে মানুষের অনুভূতিকে আকৃষ্ট করতে পারে। তার এ প্রচেষ্টা সফলও হয়। মোয়াবিয়ার কণ্ঠে ওসমান হত্যার বিচারের দাবিকে অনেকেই আন্তরিক মনে  করতে থাকে। এভাবে পদলোভী স্বার্থপর মোয়াবিয়া মুসলমানদেরকে নিয়েই ইসলামের বিরুদ্ধে বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলে। কিন্তু আলী (আ)'র শাহাদতের পর মোয়াবিয়া আর কখনও ওসমান হত্যার বিচারের দাবি মুখেও আনেনি।

 ওসমানের রক্তের বদলা নেয়ার জন্যে মোয়াবিয়া ধন-দৌলত ও সরকারী পদগুলোর সাথে ধার্মিকতাকেও যুক্ত করতে সক্ষম হয় এবং ইসলামী সাম্রাজ্যের একটা বড় অংশের অধিকর্তা হয়ে বসে। অন্যকথায়, ধার্মিকতার শক্তিকে রাজনীতি ও ধন-দৌলতের সাথে যোগ করে জনগণ তথা হযরত আলীর (আ.) অনুসারীদেরকে সংকটাবস্থায় নিক্ষেপ করে। তাদেরকে বস্তুগত দিক থেকেও যেমন সংকটে ফেলে তেমনি আত্মিক ও মানসিকভাবেও।

ইসলামী খেলাফত লাভ ও আলেম সমাজের ওপর মোয়াবিয়ার কর্তৃত্ব লাভ করা সম্ভব হয়েছিল তিনটি দিকের সমন্বয়ে। আর তা হল উমাইয়াদের, বিশেষ করে মোয়াবিয়ার কূটবুদ্ধি, পূর্ববর্তী খলীফাদের সরলতা যারা এদেরকে ইসলামী শাসন ব্যবস্থায় স্থান দিয়েছিল আর জনগণের অজ্ঞতা ও মূর্খতা।

আলী (আ.) দুনিয়া ত্যাগ করলে মোয়াবিয়া খলীফা হয়। কিন্তু আশ্চর্যের সাথে সে দেখতে পেল যে,তার ধারণাকে বদলে দিয়ে মৃত্যুর পরেও হযরত আলী (আ.) একটা শক্তি হয়েই বহাল রয়ে গেছেন। মোয়াবিয়ার ভাব-লক্ষণ দেখে বোঝা যেত যে,এ কারণে সে বড়ই উদ্বিগ্ন ছিল। তাই মোয়াবিয়া হযরত আলীর (আ.) বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডার যুদ্ধে নামে। আদেশ জারী করা হলো যে, মিম্বারে এবং খোতবায় হযরত আলী (আ.) কে অভিশাপ দিতে হবে। হযরত আলীর (আ.) অন্যতম সমর্থকদেরকে বেপরোয়াভাবে হত্যা করা হলো এবং বলা হলো যে, প্রয়োজনে মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করে হলেও তাদেরকে বন্দী করবে যাতে হযরত আলীর (আ.) গুণ-মর্যাদা প্রচার না হয়। পয়সা খরচ করে হযরত আলীর (আ.) শানে বর্ণিত হাদীসগুলো জাল করে উমাইয়াদের পক্ষে বর্ণনা করা হয়। তবুও বরাবরই উমাইয়া শাসনের জন্যে হযরত আলীর সমর্থকরা একটা হুমকি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

মোয়াবিয়া যখন দুনিয়া ত্যাগ করে তখন ইতোমধ্যে সংযোজিত কিছু বিদআত প্রথার সাথে আরও কয়েকটি প্রথার চলন করে যায়। যেমন- প্রথমবারের মতো ইসলামী সমাজে বিনাদোষে হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করার অবাধ নীতি চালু করা। এছাড়া সম্মানীয়দের সম্মান খর্ব করা এবং হাত-পা কেটে বিকল করে দেয়া।

এইসব নীতির আওতায় মোয়াবিয়া ইমাম হাসান (আ.),মালেক আশতার প্রমুখকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে।

উমাইয়া এই শাসক খিলাফতকে নিজের খান্দানে আবদ্ধ রাখতে রাজতন্ত্র প্রথা চালু করে এবং  পুত্র ইয়াজিদের মতো অযোগ্য ব্যক্তিকেও খলীফা পদে মনোনীত করে। গোত্র বৈষম্যের স্তিমিতপ্রায় আগুনকে পুনরায় অগ্নিবৎ করাও ছিল মোয়াবিয়ার আরেকটি নীতি।

ইয়াজিদ ছিল মূর্খ ও নির্বোধ। সে বড় হয় মরুভূমিতে রাজকীয় বিলাসিতায়। দুনিয়ার খবরও সে রাখতো না;পরকালেরও না। মোটকথা খলীফা হবার বিন্দুমাত্র যোগ্যতাও তার ছিল না। ইয়াজিদের যুগে এসে ইসলাম আরো বিপর্যস্ত হতে থাকে। দেশ-বিদেশের দূত এসে অবাক হয়ে দেখতো যে, রাসূলুল্লাহর (সা.) আসনে এমন একজন বসে আছে যার হাতে মদের বোতল, আর পাশে বসিয়ে রেখেছে রেশমী কাপড় পরা বানর। এরপরে ইসলামের ইজ্জত বলতে আর কি-বা থাকতে পারে? ইয়াজিদ ছিল অহংকারী,যৌন-উন্মাদ,ক্ষমতালোভী এবং মদ্যপ। এ কারণেই ইমাম হোসাইন (আ.) বলেছিলেনঃ ‘যদি ইয়াজিদের মতো দুর্ভাগা উম্মতের শাসক হয় তাহলে এখানেই ইসলামের ইতি টানতে হবে। ইয়াজিদ প্রকাশ্যে খোদাদ্রোহিতায় নামে। অন্য কথায়, এতোদিনের গোপনতার পর্দা ছিন্ন করে ইয়াজিদ উমাইয়াদের আসল চেহারাটা প্রকাশ করে দেয়। ইসলাম যদি জিহাদ করার আদেশ দিয়ে থাকে-যদি অন্যায়ের গলা চেপে ধরার আদেশ দিয়ে থাকে তাহলে এটাই ছিল তা পালনের সর্বোৎকৃষ্ট সময়। তা নাহলে,এরপর আর কি নিয়ে ইসলামের দাবী উত্থাপন করার থাকে?

তাই মু‘আবিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ খলিফা হলে ইমাম হুসাইন (আ.) এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্যে তার হাতে বাইয়াত করতে অস্বীকার করে নজিরবিহীন আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ মৃত্যুর ঝুঁকি নেন। কারণ, তিনি জানতেন, ইসলামের শুকিয়ে যাওয়া ও মুষড়ে পড়া চারাগাছ কেবল তাঁরই পবিত্র রক্তের অমিয় সিঞ্চনে পুনরায় সতেজ হবে। এ আত্মোৎসর্গ হবে মুসলিম বিশ্বের ভেতরেই হক ও বাতিলের মধ্যকার এক অবিশ্রান্ত সংগ্রামের অফুরন্ত প্রেরণার আদর্শ ও উৎসমূল। এ আদর্শ হবে মুসলিম রাজ্যে শাসনকর্তাদের জুলুম-অত্যাচার ও জনগণকে গোলামে পরিণত করার চক্রান্ত নির্মূলের মহৌষধ। রাসুলে খোদার ছোটো নাতির এই বিপ্লব আবারও মুসলিম জনপদে খোদাভীরু লড়াকু সৈনিকদের শক্তিমত্তাকে উমাইয়্যা জুলুমের ঘূর্ণিপাক থেকে বের করে উজ্জীবিত ও প্রাণবন্ত করবে।

ঘটনা বাস্তবে এমনই হয়েছিল। ইমাম হুসাইন (আ.) নিজের চোখে দেখে যেতে পারেননি, কিন্তু অচিরেই তাঁর এ আত্মদান এমনভাবে ফলবান হয়ে বিদ্যুৎগতিতে নগরে প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, খোদ ইয়াযীদের দারুল খোলাফাও তা থেকে রেহাই পায়নি। ইয়াজিদের পুত্রই উমাইয়্যা গোত্রের শত্রু”তাপূর্ণ কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে কথিত খেলাফত থেকে ইস্তফা দেয় এবং বলে: ‘আমি কখনও খেলাফতকে তার প্রকৃত হকদারের কাছ থেকে বঞ্চিত করব না।’  পার্সটুডে
captcha